এশিয়া মহাদেশের শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ মিলেমিশে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। । এখানে নেই কোন ভেদাভেদ না আছে কোন বৈষম্যতা। তবে বিশেষ কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক, বানিজ্যিক ও আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে এখানে দু ধরনের জীবনধারার মানুষ লক্ষনীয়।
যেগুলোকে গ্রামীন এবং শহুরে জীবনধারা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। প্রতিটা জীবনধারা নিয়েই এই বাংলার মানুষেরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও বহু ক্ষেত্রে এই গ্রামীন এবং শহুরে মানুষদের জীবনধারার মধ্যে কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে ৬৮০০ টির মতো গ্রাম রয়েছে এবং ৮০% এর বেশি পরিমান মানুষ গ্রাম্য পরিবেশে বসবাস করে। এদের মধ্যে আবার ৩ ধরনের জীবন ধারা লক্ষনীয়, যথা:
ক: উচ্চ–বিত্ত পরিবার
খ: মধ্য–বিত্ত পরিবার
গ: নিম্ন–বিত্ত পরিবার
এদের মধ্যে নিম্ন বিত্তবানদের গ্রাম্য পরিবেশেই নিজের জীবনধারা চালিয়ে যেতে হয়। পক্ষান্তরে উচ্চ–বিত্তবানেরা ভালো জীবন যাপনের আশায় শহুরে জীবন ধারা বেছে নেয়। কারন গ্রাম্য পরিবেশ অপেক্ষা শহুরে পরিবেশে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা অত্যাধিক সহজ।
মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে গ্রামীন জীবনধারাঃ
আমরা জানি, বেচে থাকার জন্যে কোনো মানুষের ৫ টি মৌলিক অধিকার রয়েছে, যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা। গ্রামীন জীবনধারায় অনেক সময় এই সব অধিকার যথাযথভাবে একজন সুনাগরিক উপভোগ করতে পারে না। এমন সব মৌলিক অধিকার নিয়ে গ্রামীন জীবনধারার মনস্তাত্ত্বিক চিত্র তুলে ধরা হলো:
(১)খাদ্যঃ
গ্রামীন জীবন ধারায় মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত এবং মাছ। শুধু গ্রামে বসবাসকারী মানুষদেরই নয় বরং এদেশে সকল মানুষের জাতীয় এবং প্রিয় খাবার মাছ-ভাত। কারন গ্রামীন মানুষেরা তাদের নিজের অথবা অন্যের জমিতে প্রচুর পরিমানে ধান চাষ করে। তারা জীবিকার ক্ষেত্রে কৃষক তথা ১ম শ্রেনীর এই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডটা বেছে নেয়, ফলে এদের প্রধান খাদ্য ভাত।
অন্যদিকে গ্রামীণ পরিবেশ মূলত ঘরে উঠেছে নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদিকে ঘিরে।। ফলস্বরূপ গ্রামের মানুষেরা এই নদী সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করছ। তারা নদ-নদী হতে মাছ ধরছে এবং অনেকেই এই কাজের মাধ্যমে নিজের জীবিকা নির্বাহও করছে। তাছাড়াও বাংলাদেশ হল কৃষিনির্ভর একটি দেশ। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ উর্বর জমিতে মৌসুমী শাকসবজি সহ নানা ধরনের ফলমূল চাষ করে থাকে। ফলে তাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা ভাত, মাছ ও শাকসবজি ইত্যাদি থাকেই। যেহেতু গ্রামে উচ্চ, মধ্য এবং নিম্নবিত্ত সকল ধরনের মানুষ বসবাস করে ফলে সকলের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকা একই হয় না। গ্রামের মানুষেরা নিজে সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্যের চাহিদা মেটায়।
(২)বস্ত্রঃ
গ্রামে বসবাসকারী মানুষেরা সাধারনত সাধারন কাপড়–চোপড় পরিধান করে থাকে। গ্রামের মেয়েরা শাড়ি অথবা সালোয়ার কামিজ পরিধান করে। অন্যদিকে পুরুষেরা লুঙ্গি অথবা পাঞ্জাবি-পায়জামা, ফতুয়া এসব পোশাক পরিধান করে থাকে। তবে দারিদ্রতার জন্যে অনেকে তাদের বস্ত্রের অভাব পূরনে ব্যার্থ হয়ে থাকে কারন গ্রামের মানুষেরা কম শিক্ষিত হওয়ায় তাদের সংসারে সন্তান–সন্তানাদি বেশি থাকে ফলে সঠিকভাবে সবার বস্ত্রের অভাব পূরন করতে পারে না।
(৩)শিক্ষাঃ
শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা গুলোর মধ্যে প্রধান এবং অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার সকল নাগরিকদের জন্যে সুশিক্ষার ব্যাবস্থা করেছেন। তবে শিক্ষা যেন তাদের অনেকের কাছে কিছুটা বিলাসিতাই মনে হয়। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরা নিজেদের নিত্যদিনের খাবার-টুকু যোগাড় করতেই হিমশিম খায়।সপরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় সকলের পক্ষে শিক্ষার স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। এছাড়াও গ্রামগঞ্জে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও অতি নগণ্য, ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকই শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগটুকু পাচ্ছেনা।বাক্যটি করে সম্পূর্ণ অর্থ বোঝা যাচ্ছে না, পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন।
(৪) বাসস্থানঃ
গ্রামের মানুষদের জমির পরিমাণ কম হওয়া এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার ফলে তাদের ছোট একটি ঘরে সকলকে নিয়ে বসবাস করতে হয়।ফলে বাসস্থান গত অনেক সমস্যা তৈরী হয়।
(৫) চিকিৎসাঃ
গ্রামে উন্নত চিকিৎসা, দক্ষ চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সবকিছুর অভাব রয়েছে। গ্রামের নেই পরিমিত হাসপাতাল। প্রতিটা ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে হাসপাতাল থাকে এবং সেই হাসপাতালগুলোর পরিবেশও একজন অসুস্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কোন জটিল রোগে আক্রান্ত হলে গ্রামের মানুষদেরকে শহরে ছুটতে হয়।
এছাড়াও শিক্ষার অভাবের ফলে গ্রামের মানুষেরা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভোগার পরেও সচেতনতার অভাবে তারা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। যদিও আরো উন্নত চিকিৎসার জন্যে তারা শহরের উপর নির্ভরশীল।
গ্রামীন জীবন–ধারার সুবিধাঃ
গ্রামের মানুষেরা সুন্দর, নিরিবিলি এবং সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির মাঝে আবদ্ধ।এখানে শহুরে জীবনের মতো ব্যাস্ততা নেই। সহজ সরল জীবন যাপন করতেই গ্রামের মানুষেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।গ্রামের মানুষগুলো আসলেই খুব সরল। তাদের মধ্যে রয়েছে এক অটুট বন্ধন, একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়ানো এবং সাহায্য সহযোগিতা করায় তারা একটুও পিছু সরে যায় না। গ্রামের এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো অত্যাধিক পরিশ্রম করে ফলে, তারা শারীরিকভাবেও অনেক সুস্থ থাকে। নিজের জমিতে ফলানো তাজা শাক-সবজি আহার করেই তারা যেন এক অন্যরকম প্রশান্তি পায়। তাদের নেই কোনো বাড়তি চাহিদা, জীবনে কত শত সমস্যার পরেও একে অপরের সাথে হাসিখুশিতে নিজেদের দিন অতিবাহিত করছেন তারা।
গ্রামীন জীবন-ধারার অসুবিধাঃ
গ্রামের মানুষদের জীবনটা সহজ সরল হলেও, তাদেরকেও প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।এত পরিশ্রম করার পরেও তারা দিনশেষে নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতেই হিমশিম খায়।এত পরিশ্রম করার পরেও তারা দিনশেষে নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতেই হিমশিম খায়।সুশিক্ষা গ্রহণে, উন্নত এবং সঠিক চিকিৎসা লাভের আশায় গ্রামের মানুষগুলো ক্রমাগত শহরমুখি হচ্ছে।যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থাও খুব বেশি ভালো না থাকার ফলে গ্রামের মানুষগুলো তেমন লাভজনক ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে পারছে না। শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ইত্যাদিও গড়ে উঠছে না ফলে তাদের আর্থিক অবস্থা এখনো অনেকটাই অসচ্ছল।
মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে শহুরে জীবন–ধারাঃ
(১)খাদ্যঃ
শহরের মানুষগুলো নিজেদের খাদ্যের যোগান অতি সহজেই দিতে পারে এবং তারা অত্যাধিক ভোজন রসিক হয়ে থাকে।শহরে অতি সহজেই সবকিছু ভোগ করা যায় মাছ-মাংস, শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের ফলমূল। এদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা কম হওয়ায় সবার খাদ্যের যোগান সহজেই দিতে পারে।
(২)বস্ত্রঃ
এদের বস্ত্রের মাঝে শিল্পকর্মের ছাপ অধিক। পরিবারে লোক সংখ্যা কম হওয়ায় এদের বস্ত্রের অভাব তেমন নেই।
(৩)শিক্ষাঃ
শহরে বসবাসকারী মানুষগুলো অধিক সচেতন হয়, তারা শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত। শহরে রয়েছে সরকারি বেসরকারি ভালো ভালো স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে গ্রামের মানুষরাও সচেতন হয়েছে এবং সুশিক্ষা ও নিজের জীবনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যই শহরমুখি হচ্ছে।
(৪)বাসস্থানঃ
শহুরে মানুষেরা চাকরি অথবা ব্যাবসার জন্যে নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একক পরিবার গঠন করে ফলে একক পরিবারে বাসস্থানের কোনো সমস্যা হয় না।
(৫)চিকিৎসাঃ
বেঁচে থাকার জন্যে এই মৌলিক অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারন অসুস্থতা একটি অভিশাপ স্বরূপ। শহরে রয়েছে উন্নত মানের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ। ভালো ভালো হাসপাতাল, দক্ষ চিকিৎসক কোন কিছুরই কমতি নেই। তাই শহরের মানুষদেরকে উন্নত চিকিৎসা পেতে কোন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। অধিক চিকিৎসালয় থাকায় শহুরে মানুষেরা ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।
শহুরে জীবন-ধারার সুবিধাঃ
একজন নাগরিকের সুস্থ, সবল এবং সকল সুবিধা উপভোগ করে বাঁচার জন্যে শহুরে জীবন এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া শহরে পরিবহন ব্যাবস্থা ভালো ফলে সহজেই ব্যাবসা–বানিজ্য করা যায়। এখানে মানুষেরা সুবিধাভোগী হয়ে বাস হয়ে।শহরে রয়েছে ভালো ভালো কোম্পানি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। শহরের চাকরি পাওয়াও অধিক সহজ ফলে, গ্রামের তুলনায় এখানে বসবাসকারী মানুষদের জীবন আর্থিকভাবে অধিক সচ্ছল।
শহুরে জীবন-ধারার অসুবিধাঃ
এখানে সকল সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পাওয়া দুষ্কর। কোলাহল, যানবাহনের ধোয়া, দূষনে মোড়া শহরের পরিবেশ। এছাড়াও বড় বড় ইমারতে ঘেরা এই শহরে বসবাসকারী মানুষদের প্রতিবেশীদের সাথে তেমন মিলবন্ধন নেই, তাদের বিপদে কাউকে পাশে পাওয়াও কঠিন।শহরে বসবাসকারী ছেলেমেয়েরা সব সময় চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকে, নেই কোন খেলার মাঠ তাদের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়াও শহরে বসবাসকারী বেশিরভাগ পরিবারেই বাবা-মা উভয় চাকরি করার ফলে সন্তানেরা অনেক সময় বাবা-মার আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয় এবং তারা ডিভাইসের প্রতি অনেক বেশি আসক্ত হয়ে যায়। যেমন, বেশিরভাগ সময় একা থাকার ফলে বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ইত্যাদির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। শহরের বসবাসকারী ছোট-বড় সকলেই একাকিত্বে ভোগে, ফলে তাদের মানুষিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পরে। তাছাড়া শহরের ব্যাস্ত জীবন মানুষের সুন্দর জীবনকে উপভোগ করা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
মূলত গ্রামীন পরিবেশের মানুষ যেমন দেশের প্রধান শিকড় ধরে আছে তেমনি শহুরে পরিবেশের মানুষ দেশকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নতির উচ্চ শিখরে।
আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখক
মোঃ রায়হান কবীর
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE