একদম নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি, যে পথে নেই কোনো প্রাণীর কোলাহল, শুধু রয়েছি আমি এবং চারপাশের অস্বস্তিকর নিস্তব্ধ প্রকৃতি। এই বনাঞ্চলে পা রাখতেই মনে হচ্ছে, মাটির বুক ফুঁড়ে সর্পিলাকারে উঠে আসা বৃহদাকৃতির গাছপালা আমাকে পাকড়াও করার জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়েছে। অস্বস্তিকর নির্জনের মাঝে পায়ের নিচে পিষে যাওয়া শুকনো পাতার মর্মর শব্দটা কানে সুইয়ের মতো বিঁধে। না! বানোয়াট কোনো গল্প বলছি না, বরং Hoia-Baciu বনে ঘুরে আসা প্রত্যেকটি পর্যটকের অভিজ্ঞতা ঠিক এরকমই হয়। 

Hoia-Baciu Forest 

Hoia-Baciu বন, রোমানিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশে Transylvania, Cluj County তে অবস্থিত। Transylvania তে পর্যটকদের আসার মূল লক্ষ্য হলো, Bran CastlePoenari Castle এ ড্রাকুলার দেখা পাওয়া যায় কিনা। তবে সত্যিকারের ড্রাকুলার খোঁজ না মিললেও Transylvania এর আসল রোমাঞ্চকর রহস্য লুকিয়ে আছে ২৫০ হেক্টর জমি জুড়ে অবস্থিত Hoia-Baciu বনাঞ্চলে। ঘটে যাওয়া সমস্ত অদ্ভুত ও অবর্ণনীয় ঘটনার কারণে এই বনকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর বন বলে গণ্য করা হয়। চলুন প্রবেশ করা যাক, ভৌতিক এই বনের গহীনে। 

Hoia-Baciu বনের অদ্ভুত গাছপালা 

এই বনে শুধু অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে না বরং এই বনের গাছপালাও বেশ ভৌতিক ধরনের। গাছগুলো সোজা হয়ে নয়, বরং বাঁকা হয়ে সর্পিলাকারে বেড়ে উঠে। প্রথম দেখাতেই মনে হবে, গাছগুলো এদের অঙ্গপ্রতঙ্গকে মোচড় দিয়ে আপনাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, প্রতিটি গাছই ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরে বেড়ে উঠতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই গাছগুলোর বৃদ্ধির ধরন পরীক্ষার জন্য এই বনে গিয়েছেন, কিন্তু কেন এই গাছগুলো এরকম অদ্ভুতভাবে বেড়ে উঠে তার উত্তর বের করতে পারেনি। 

মৃত অঞ্চল

এই বনের একটি অঞ্চল “মৃত অঞ্চল” নামে পরিচিত। এই এলাকাটি একটি নিখুঁত বৃত্ত, এই বৃত্তাকৃতির এলাকার অভ্যন্তরে কোনোকিছুই জন্মায় না, যার ফলে নেই কোনো গাছপালাও। এই অঞ্চলে কোনো উদ্ভিদ কেন জন্মায় না তা নিয়েও বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। এর জন্য তারা মৃত অঞ্চলের মাটির নমুনা সংগ্রহ করেন, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। কেন এই অঞ্চলে কোনো উদ্ভিদ নেই তার জবাব বিজ্ঞানীরা আজও দিতে পারেননি। 

স্থানীয়দের মতে, এই মৃত অঞ্চলটিতে বেশ কিছু অলৌকিক কার্যকলাপ দেখা গেছে। আপনি যখন এই মৃত অঞ্চলে পা রাখবেন, তখন আপনার মনে হবে, আপনি পুরো Transylvania এর অংশ হতে অপসারিত হয়েছেন এবং পুরো বনটি আপনাকে বেষ্টন করে আপনার দিকে নজর রাখছে। 

Hoia-Baciu বনের লোককাহিনী 

রহস্যে ভরা এই বনকে ঘিরে বেশ কিছু ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয়রা বলে থাকেন যে, একবার এক যুবতী এই বনে প্রবেশ করেছিলো এবং এরপরে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ৫ বছর পরে তিনি বন থেকে ফিরে আসেন৷ তিনি বেশ অসহায় অবস্থায় ছিলেন এবং গত ৫ বছর তিনি কোথায় ছিলেন তা মনে করতে পারছিলেন না।

Hoia-Baciu বনের নাম একজন রাখালের নামানুসারে রাখা হয়। স্থানীয়দের মতে, রাখাল তার ২০০ টি ভেড়ার পাল চড়াতে এই বনে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু সেই বন থেকে আর কখনো বের হয়ে আসেননি। পরবর্তীতে খোঁজ করার পরেও তার এবং ভেড়ার পালের দেহাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

Hoia-Baciu বন প্রথম যেভাবে সবার নজরে আসে 

প্রকৃতপক্ষে, বনটি প্রথম বিখ্যাত হয়েছিলো ১৯৬৮ সালে যখন সামরিক প্রযুক্তিবিদ এমিল বার্নিয়া তার বান্ধবী এবং দুইজন বন্ধুর সাথে বনে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন।

আগস্টের রৌদ্দ্রজ্জ্বল একটি বিকেলে বনে ঘোরাফেরার এক পর্যায়ে বার্নিয়ার বান্ধবী কিছু একটা দেখে চমকে উঠে এবং বার্নিয়াকে তা দেখার জন্য সাথে সাথে ডাক দেয়। বার্নিয়া ও তার বান্ধবী দুইজনই আকাশে সিলভার ডিস্কের মতো একটি বস্তু দেখতে পায়। ভাগ্যক্রমে, বার্নিয়ার সাথে ক্যামেরা ছিলো এবং বস্তুটি সরে যাওয়ার আগেই এর চারটি ছবি তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাদের চারজনই দুই মিনিটের জন্য বস্তুটি দেখতে পান। বার্নিয়ার তোলা চারটি ছবিই বেশ জীবন্ত ছিলো। বার্নিয়ার এই ছবিগুলো স্থানীয় কাগজপত্রে প্রকাশিত হলে বেশ কিছু লোক এর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে। তারা দাবি করে যে, হয়তো বস্তুটি আবহাওয়ার বেলুন ছিলো যা অদ্ভুত আলোতে তোলা হয়েছে।

বার্নিয়া যেদিন বনে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, সেদিন ওই এলাকায় আকাশে থাকতে পারে এমন আবহাওয়ার বেলুন, ক্লিম্পস বা অন্য যেকোন কিছুর খোঁজ নিয়ে দেখেন তদন্তকারীরা। কিন্তু ছবিগুলোর ব্যাখা করার মতো সেরকম কিছুই পাওয়া যায়নি। 

বার্নিয়া কোনোভাবে ছবিগুলোকে পরিবর্তন করেছে কিনা তার জন্যও ছবির নেগেটিভগুলো পরীক্ষা করা হয়, তবে টেম্পারিংয়ের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

বার্নিয়া অদ্ভুত জিনিসটিকে UFO বলে দাবি করেছিলো এবং স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে জিনিসটি রিপোর্ট করেছিলো। তবে ছবিগুলোতে কেউ বিশ্বাস না করায় বার্নিয়াকে পাগল বলে গণ্য করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিলো।

সেদিন বার্নিয়া আসলে কী দেখেছিলো তা একটা রহস্যের চাদরেই ঢাকা পড়ে গেছে।

 Hoia-Baciu বনের আদিকথা 

স্থানীয়লোক বিশ্বাস করেন যে, এই বনটি বহুকাল আগে খুন হওয়া কৃষকদের প্রেতাত্মা দিয়ে আচ্ছন্ন। বনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ৬৫০০ খ্রিষ্টাব্দে নিওলিথিক যুগে সমগ্র রোমানিয়ার প্রাচীনতম বসতি এখানে স্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু তা পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে যায়। কালের পরিক্রমায় এই জায়গাটি Hoia-Baciu বনভূমিতে পরিণত হয়। 

Hoia-Baciu বনে পর্যটনদের ভৌতিক অভিজ্ঞতা  

এই বনে দিনের বেলাতে তেমন সমস্যা না হলেও, সন্ধ্যার সময় কাছাকাছি হলেই বেশ কিছু ভৌতিক কার্যকলাপের সম্মুখীন হতে হয়। বেশ কিছু মানুষ এই বনে মহিলাদের হাসির শব্দ বা যুবতীদের চিৎকার শোনার দাবি করেন। বহুলোক এই বনে প্রবেশ করার পর থেকেই গুরুতর উদ্বেগে ভোগে এবং সর্বদাই তাদের মনে হতে থাকে কেউ তাদের পিছন থেকে অনুসরণ করছে। অনেকে আচঁড়ের দাগ নিয়ে বের হয়ে আসে, কিন্তু এই দাগ কীভাবে আসে তার ব্যাখা তারা দিতে পারে না।

যে বনে প্রানীর কোনো অস্তিত্ব নেই, সেই বনে মানুষ, হরিণ বা ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজও পেয়ে থাকে। যারা এই বনের রহস্য উদঘাটনে রাতযাপন করেছেন তাদের মাঝে অনেকেই এই ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হয়েছেন। এরকমই এক দলের লোক সেখানে রাক্ষস দেখেছেন বলে পাগলের মতো করতে থাকেন, যদিও তার সাথের বাকিরা এরকম কিছু দেখতে পায়নি। স্থানীয়রাও এই বনে প্রবেশ করতে চায় না।

এই বনকে রোমানিয়ার Bermuda Triangle ও বলা হয়। কেননা আগে প্রায়ই এই বনে প্রবেশকৃত লোকদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না। এছাড়াও বিশাল এই বনের অদ্ভুত গাছপালা আপনাকে যেকোন সময় গোলক ধাঁধায় ফেলে দেয়ার জন্য প্রস্তুত। এই বনে প্রবেশের সাথে সাথে যেকোন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ হয়ে যায়। বনের মানচিত্র ছাড়া এর বেশি গহীনে গেলে, আপনি কখন এই বনের মায়াজালে আটকা পড়েছেন তা বলতেও পারবেন না।

তবে বনের এত অপ্রীতিকর ঘটনা থাকা সত্ত্বেও, দিনের বেলায় দেখার জন্য বনটি বেশ সুন্দর একটি জায়গা। Sci-fi  মুভির মতো অদ্ভুতুরে এই গাছগুলো কেবলমাত্র এই বনেই দেখা যায়। এছাড়াও এখানে সাইক্লিং, হাইকিং এর জন্য বেশ সুন্দর পথ রয়েছে।

এই বনের ঠিক পাশেই রয়েছে Cluj-Napoca নামক বড় শহর। বনটি শহরের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এখানে বাসস্থান খুঁজে পাওয়াও সহজ। Cluj-Napoca কেন্দ্র হতে মাত্র ২০ মিনিটের ড্রাইভিং এ পৌঁছানো যায় এই শহরে, যার ট্যাক্সি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় না। আপনি যাতে বনে হারিয়ে না যান তার জন্য গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই বনে শিশুদের নিয়ে যাওয়া উচিত না এবং সন্ধ্যার পর এই বনে না থাকাই ভালো।

Hoia-Baciu নামক লোমহর্ষক এই বনের সম্পর্কে মোটামুটি সবই এখন আপনি জানেন। তবে এই বনের আসল রহস্য উদঘাটনে এবং স্বচক্ষে এই ভৌতিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণে আপনিও যেতে পারেন Hoia-Baciu বনে। 

Hoia-Baciu বনের গাছপালা সর্বদাই আপনাকে স্পর্শের অপেক্ষায় আছে, আপনি যাবেন তো? 

 আরো ব্লগ পড়তে এখানে #ক্লিক  করুন

Writer,

Diderul Islam 

Intern, Content Writing Department 

YSSE

 

4 thoughts on “রোমানিয়ার লোমহর্ষক জঙ্গল: Hoia-Baciu Forest.”
  1. আমাদের বিশ্বের মধ্যে এই রকমও একটি বন আছে তা এই ব্লগের মাধ্যমে জানতে পারলাম। অনেক সুন্দর লিখা ছিল এটি।

  2. যখনই গল্পটি পড়া শুরু করলাম তখন থেকেই একটা অন্যরকম আগ্রহ কাজ করতে লাগলো এরপর কী হলো। যাই হোক খুবই ভয়কর কিছু তথ্য জানতে পারলাম। ধন্যবাদ YSSE কে এরকম ব্লগ পোস্ট করার জন্য।

    1. জঙ্গলটি সম্পর্কে আগে শুনলেও পুরোপুরি কখনো জানা হয়নি আজকে এই ব্লক থেকে সম্পূর্ণ তথ্য গুলো পেলাম অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *