তারপর সকলের অনেক অনুনয়-বিনুনয় আর বহু অনুরোধের পর এত বছরে প্রথমবারের মত তারেক বিয়ে করার কথায় সম্মতি জানাল। অহনার ছোট বোনের সাথে বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব পেশ করা হলো কিন্ত বয়স অনেক কম হওয়ার কারণে তার সাথে বিয়েটা হলো না। 

এরপর নিজের গ্রামের পাশের বাড়ির সরকারি শিক্ষকের এক শহুরে শিক্ষিত পরিবারের সুন্দরী, লম্বা-চওড়া এক মেয়ে। মেয়ের পরিবারের থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসে। কারণ মেয়ের পরিবার তাদের পূর্ব পরিচিত হওয়ার দরুন ছেলের সম্পর্কে সব কিছুই ভালভাবে জানে এবং যেহেতু ছেলে চাকরিসূত্রে ঢাকা থাকে ও মেয়ের পরিবারও ঢাকায় বসবাস করে তাই মেয়ের পরিবারই এই বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব দেন। 

তারপর গ্রাম থেকে অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়ে গিয়ে ঢাকায় ঘরোয়াভাবে ছোট খাট আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হল। 

তারিকের বর্তমান বউ কমবয়সী, এস.এস.সি পাশ, তেমন পড়াশোনা করেনি।

কয়েক মাস শ্বশুরবাড়িতে থাকার পর ঢাকায় বাসা ভাড়া করে বউ নিয়ে থাকা শুরু করল তারিক। এবং নিজের মেয়েকেও ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসেন তিনি, ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তাকে। তারিকের বর্তমান বউ

সেই মেয়েকে মায়ের মতই আদর-স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করতে লাগল। 

ভালভাবেই দিন কাটছিল নব-দম্পতির। মাঝে মাঝে ঈদে কিংবা ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে আসত তারা। এভাবেই বছরখানেক কাটল।

এবং নব-দম্পতির কোল আলো করে এল এক পুত্র সন্তান। দেখতে বাবার মতো ফর্সা, লম্বা,সুদর্শন,

ইউরোপিয়ানদের মতো চেহারা। 

দুই সন্তান নিয়ে হেসে খেলে দিন কাটছিল তারিকের। সৌখিন,রুচিশীল ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্যতার দরুন নিয়মিত কেনাকাটা (শপিং), প্রতি ছুটির দিনে ঘুরে বেড়ানো, পুরো ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান দর্শন করা, বিভিন্ন নামী-দামী রেস্টুরেন্ট, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া ছিল নিয়মিত রুটিন এবং জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।  

জীবনে অনেক খুশি ছিল তারিক। সুখী দম্পতির সফল উদাহরণ ছিল তারিকের সংসার।

 

তারপর এক কোরবানির ঈদে বাড়ি আসার সময় সকলের জন্য কাপড়-চোপড় কেনা, ট্রেনের টিকেট কাটার পর হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ে তারিক। সারা শরীরে প্রচুর এলার্জি দেখা দেয় তার। 

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট করতে দেন। টেস্ট করার পর তারিকের একটি কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। 

বাড়িতে এই সংবাদ পৌঁছানোর পর সকলে দুশ্চিন্তা ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। এত কম বয়সে এ কঠিন রোগ দেখা দেয়ায় সকলে হাহাকার জুড়ে দিল।

এ রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল আর অনিশ্চিত তার উপর তারিকের দুটো ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে।

যেই তারিকের এই অবস্থার কথা শুনে সেই হা হুতাশ করে।

 এদিকে দিনের পর দিন তারিকের শরীরের অবনতি হতে থাকল। ফলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো, ঈদে আর বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হলো না তারিকের। 

এভাবে ২২ দিন হাসপাতালে কাটালো তারিক। 

এরপর একটু সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসল সে। 

বাসায় কয়েকদিন থাকার পর বাড়িতে আসল 

তারিক। যদিও এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি; ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কঠোর বিধিনিষেধ, ঔষধ ও নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা অনুসরণ করে চলছে সে।

তারিক বাড়ি এসেছে শুনে গ্রামের বহু মানুষ তাকে দেখতে তার বাড়িতে ভিড় জমাল এবং অনেক মানুষ হাত তুলে আল্লাহর কাছে তার জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করল।

কয়েকদিন থাকার পর আবার কর্মস্থলে ফিরে গেল তারিক। 

এভাবেই বছরখানেক কেটে গেল। এরপরে তারিকের বাবা মারা গেল। তারিকের অসুস্থতার সময় তার বাবা বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি আমার জীবন নিয়ে নেন, তবুও আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখুন। বাবার মৃত্যুতে সবাই শোকাহত হয়েছিল। তার কিছুদিন পর ছোট ভাইকে বিয়ে করাল তারিক যেন সে বউ নিয়ে মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতেই থাকে। জীবনের নানা রকম ব্যস্ততায় সকলেই দূরে থাকে, মা যেন একা না হয়ে পড়ে তাই এ ব্যবস্থা করে তারিক। 

কয়েক মাস পর আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তারিক। ভালো হয়ে যাওয়ার পর তারিক না বুঝেই আর চেক আপে যায়নি, ঠিকমত ডাক্তারের বিধিনিষেধ মেনে চলেনি। এরমধ্যে হঠাৎই একদিন অ্যালার্জি হওয়ায় ডিসপেনসারি থেকে ঔষধ কিনে খেয়েছিল সে। দিন দিন তারিক আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে ফলে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হয় সে। তিন মাস হাসপাতালে ছিল সে।

শরীর সুস্থ হলে ইন্ডিয়া যাওয়ার ও কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা থাকলেও শরীর সুস্থ হচ্ছে না বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছিল তার। দেড় মাস পর মারা গেলো তারিক। তারিকের বউ ছেলেকে নিয়ে উপজেলা শহরে নিজের বাবা মায়ের সাথে বসবাস শুরু করেন। তারিকের মেয়ে পুনরায় তার নানার বাড়িতে থাকা শুরু করে।

সাল ২০২২। বর্তমানে তারিকের মেয়ে সরকারি হাসপাতালের একজন প্রতিষ্ঠিত নার্স আর ছেলে সরকারি মেডিকেলের ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষা দিয়ে ইন্টার্নশিপের জন্য অপেক্ষা করছে।

জীবনের স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে সকলেই আজ যার যার মত প্রতিষ্ঠিত জীবন যাপন করছে।

শুধু মাঝে মাঝে জীবনের বাঁকে বাঁকে গল্প কথায় উঠে আসে তারিক। সেই সাহসী,চমৎকার ব্যক্তিত্বের মানুষ যার স্মৃতিচারণ হয় শ্রদ্ধার সাথে এবং সেই স্মৃতিচারণের সাথে হয়ত কখনো মিশে থাকে কষ্ট, হাহাকার আর গোপন দীর্ঘশ্বাস। 

 

“আমি চলে যাব বলে

চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে

নরম গন্ধের ঢেউয়ে?

লক্ষী পেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষীটির তরে?

সোনার স্বপ্নের সাধপৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব;

খেয়া নৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;

পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-

এশিরিয়া ধূলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে।”

-জীবনানন্দ দাশ 

 

—সমাপ্ত—

 

(বি.দ্র. সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত গল্প)

 

আমাদের আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

লেখক

 

Kulsuma Bahar Bethi 

 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

 

YSSE