জাতীয়তাবোদের সংগ্রাম ও আত্নঅধিকারের দাবিতে ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধ। এ মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনতা অংশগ্রহণ করেন, এসব জনতার মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করেছে। কেউ প্রত্যক্ষ আবার কেউ পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তাই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের বীরত্বপূর্ণ অবদান ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। এজন্য আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার নারী কবিতায় বলেছেন-
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের বিভিন্ন ধরনের উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডগুলো–
(১) সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ
স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে কিছু নারী সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তারা কলকাতার পামপুকুর এবং পার্ক সার্কাসের মধ্যবর্তী এলাকায় প্রশিক্ষণ গ্রহন করে যুদ্ধে অংশ নেন। এ প্রশিক্ষণে প্রায় ৪০০ জন নারী অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– তারামন বিবি, করুণা বেগম, শিশির কণা, আশালতা এবং বিথীকা বিশ্বাস।
উদাহরণস্বরূপ, তাদের মধ্যে একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন করুনা বেগম। তার বাড়ি ঢাকা–বরিশাল মহাসড়ক দোয়ারিকা শিকারপুর ফেরিঘাটের সঙ্গে বাকুদিয়া গ্রামে অবস্থিত। তার স্বামী শহীদুল যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর পাক হানাদার বাহিনীদের গুলিতে নিহত হন। করুনা বেগমের স্বামী মৃত্যুর একমাস পর তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন এবং বরিশালে মুলাদি থানার কুতুববাহিনীতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। তিনি এ বাহিনীর ৫০ জন নারী যোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
তিনি ছদ্মবেশে, যেমন– মানসিক ভারসাম্যহীণ, পাগলী সেজে পাকহানাদার বাহিনীদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাতেন। এ তিনি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীদের শক্ত ঘাটি ছিল মাহিলাড়া। সেখানে তার নেতৃত্বে ৫ জন নারী ও ৬ জন পুরুষ এই ঘাটি আক্রমণ করেন। করুণা বেগম নিজেই পর পর ৫ টি গ্রেনেড ছুড়ে আক্রমণ শুরু করেন এবং তারা ৪ ঘন্টা যুদ্ধ চালিয়ে যান। এ আক্রমণে ১০ জন পাক বাহিনী নিহত হয়।
(২) সহযোগী যোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধে অনেক নারী ছিলেন যারা যুদ্ধ করতে জানতেন না বা কোন প্রশিক্ষণ ছিল না তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। যেমন– মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোলাবারুদ পৌছে দেয়া, অস্ত্র পৌঁছে দেয়া প্রভৃতি কাজ করেন। এসব সহযোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– কাফন বিবি, ভানু নেছা, আমেনা বেগম, মোমেনা বেগম।
(৩) অস্ত্র সংরক্ষণকারী
স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও পাকহানাদার বাহিনী এবং তাদের অনুগত বাহিনীর ভয় উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ ও বহন করেছেন নারীরা বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র, যেমন– মাটির তলায়, মাটির পাত্রে, শৌচাগার, আলমারি, বিছানার নিচে, রান্নাঘরসহ প্রভৃতি জায়গায় লুকিয়ে রাখতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পৌঁছে দিতেন।
(৪) জনমত গঠন
মুক্তিযুদ্ধে নারীরা বিভিন্নভাবে দেশে ও দেশের বাইরে জনমত গঠন করেন। বিভিন্ন সংগঠন সভা–সমাবেশ আয়োজন করে এবং পাক বাহিনীর বর্বরতার কথা তুলে ধরে জনমত গঠনে সহায়তা করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– মিসেস নুরজাহান মোর্শেদ এমএনএ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, রেখা সাহা প্রমূখ জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
উদাহরণস্বরূপ, মিসেস নুরজাহান মোর্শেদ এমএনএ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য হিসেবে ভারতের বিভিন্ন স্থানের পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করে পাক বাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে অবহিত করেন।
(৫) সেবা–শুশ্রুষা
আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার দায়িত্ব পালনে নারীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তারা বিভিন্ন অঞ্চলের হাসপাতাল ও নার্সিং হোম গুলোতে সেবা প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপ, সিরাজগন্জের ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম। তিনি সেনাবাহিনীর মহিলা অফিসার ও চিকিৎসক হিসেবে হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি হাসপাতালে আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন।
(৬) অনুপ্রেরণা প্রদান
মুক্তিযোদ্ধারা যখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ত তখন নারীরা উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করতেন। অনেক মা তাদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ প্রদান করেন। উদাহরন হিসেবে বলা যায় যে, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম দেশ রক্ষার্থে তার নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করেন।
(৭) তথ্য সরবরাহকারী
মুক্তিযুদ্ধে নারীরা তথ্য আদান–প্রদানে এক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা রাজাকার, আল–শামস, আল–বদরসহ প্রভৃতি পাকিস্তান সমর্থিত বাহিনীর গতিবিধি ও গোপন খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ করে।
(৮) মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ধুদ্ধকরণ
নারীরা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন– অনুপ্রেরণামূলক গান গেয়ে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় যে, শাহনাজ বেগমের কন্ঠে ‘ সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা‘, কল্যাণী ঘোষের কন্ঠে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে‘- এ রকম অসংখ্য গান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা দেশরক্ষার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন।
সর্বশেষে বলা যায় যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে এভাবেই নারীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।
আমাদের আরও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Writer
Md. Sazid Alam
Intern, Content Writing Department
YSSE