বই কিনে কেউ কখনো ব্যর্থ হয় না, হয়তো কথাটিকে আজ একটু ভিন্নভাবে বলতে হবে – বই বিক্রি করে কেউ কখনো ব্যর্থ হয় না।

আজকে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি এমনই এক সৎ, নিষ্ঠাবান,উদার ও সংগ্রামী মানুষের  গল্প, যিনি তাঁর জীবন যুদ্ধে মনে হয় কখনো হার মানতে শিখেননি। মনে হয়, বয়স তাঁর জন্য কোনো বাধাই না, কোনো কাজ তার জন্য কখনো ছোট না, অর্থ ইনকাম তাঁর প্রধান লক্ষ্য নয়। দিন যায় ক্ষণ যায়,‌ তার সাথে প্রবল হয় মানবতার জন্য ভালো কিছু করে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। সেই সূত্র ধরেই লেখা শুরু। তারপর বিক্রয়। দেখতে দেখতে প্রথম বই ,২৩,০০০ কপি বিক্রি হয়। অবাক করা কান্ড হলেও সত্য তিনি নিজেই ফেরি করে বিক্রি করেন। শুনতে খুব আশ্চর্যজনক আর অনুপ্রেরণাময় হলেও তার পেছনের গল্প অনেক কষ্টদায়ক।আজকে আমাদের “Careership: Your Adventure is Out There” ক্যাম্পেইনের এই গল্পটি হলো এমনই এক লেখককে নিয়ে যা হয়তো অনেক স্বপ্নবাজদের অনুপ্রেরণা দিতে সাহায্য করবে, মানবতার ফেরিওয়ালা মানুষদের আরও উৎসাহ দিবে।

 

অনেক সময় পেরিয়ে গেল তবে সেই মহান ব্যক্তিত্বের নাম জানা হলো না।

চলুন নামসহ বিস্তারিত ভাবে তাঁর পেছনের গল্পটা জেনে আসি।

 

YSSE : প্রথমেই আপনার নাম বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা নিয়ে জানতে চাই।

অতিথি: আমার নাম মোঃ টিপু সুলতান বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার সরিষাডুলী গ্রামে। আব্বা সাধারণ ব্যবসায়ী ও কৃষিউদ্ভাবক ছিলেন। আমরা চার ভাই চার বোন। ভাইয়েদের দিক থেকে তৃতীয় আমি।লেখাপড়া সরিষাডুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়, শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা পৌর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। পরবর্তী সময় আমলা সরকারি কলেজ থেকে  বি.এ পাস করি। পড়াশুনায় উদ্দেশেই মূলত ঢাকায় আসা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি এক কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে কর্ম জীবনে পদার্পণ হয়। ১১ মাস ১০ দিন‌ চাকরি করি। কাজ আর ভালো লাগে না পরবর্তীকালে সিসিটিভি ও‌ টেলিকমিউনিকেশনের ব্যবসা শুরু করি।

 

YSSE : আপনার লেখালিখিটা কবে শুরু হয়? লেখালেখির পেছনের গল্পটা জানতে চাই।

টিপু সুলতান : ২০১৬ সাল থেকে আমি লেখা শুরু করি।

মানুষতো মরণশীল। তাই, কিছু স্মৃতি রাখার জন্য আমি লেখালেখি শুরু করেছিলাম।

 

YSSE : আপনার প্রথম বই “রেলপথে বাংলাদেশ” তা ২০১৯ অবধি ১,২৩,০০০ কপি বিক্রি হয়েছে। রেলপথে বাংলাদেশই কেন? এর প্রকাশনায় আপনাকে কোনো বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে?

টিপু সুলতান : ২০১৭  সালে প্রথম বই লিখলাম “রেলপথে বাংলাদেশ”

বিভিন্ন জায়গায় তথ্য নিতে বিভিন্ন স্টেশনে সরকারি রেলপথ মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরে যেতে হয়েছে। তথ্য নিতে যদিও একটু ঝামেলা পোহাতে হয়, তবে বিক্রয় করতে খুব লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছিল। আগে যিনি মন্ত্রী ছিলেন তিনি আমাকে বইটি বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যবশত রেলওয়ে অধিদপ্তর আমাকে অনুমতি দেয় নাই। তখনকার যে মন্ত্রী ছিলেন তাকে বললাম আমি অনুমতি পাচ্ছি না, আপনি আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর অনুমতি পেলাম না।

 

YSSE : তারপর আপনি কিভাবে বিক্রয় করেন?

  • টিপু সুলতান : যখন কোথাও থেকে সাড়া পেলাম না আমি নিজেই হকারি করে বই বিক্রয় শুরু করি এবং সফলভাবে বিক্রয় করি।

বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিক্রয় করা নিষেধ একজন হকারের। কিন্ত সবাই করে। কেউ ঝালমুড়ি বিক্রি করে কেউবা বিড়ি-সিগারেট। আমিও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বই বিক্রি করি। আমাকে অনেক সময় নিষেধ করে, গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়,এমনও হয়েছে আমাকে স্টেশনে আটকে নিয়েছে। “কেন আপনি বই বিক্রি করছেন! আপনার কি অনুমতি আছে?” “আমি বললাম না, অনুমতি পাই নি।”

 এভাবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও বই বিক্রি করেছি আমি।

 

YSSE: আপনি বেশ কিছু মানচিত্র তৈরি করেছেন।

তার মধ্যে ঢাকা জেলার মানচিত্র, কুষ্টিয়া জেলার মানচিত্র ও অন্যান্য মানচিত্র আছে। মানচিত্র নিয়ে যদি বিস্তারিত ভাবে কিছু বলতেন।

টিপু সুলতান : বই লেখা শেষে মানচিত্রে চলে গেলাম।

প্রথমে তৈরি করলাম মেহেরপুর জেলার মানচিত্র।

মেহেরপুর জেলায় ২৭৯টি গ্রাম ১৮টি ইউনিয়ন, প্রতিটি ইউনিয়নের ভৌগোলিক এরিয়া করে, কোন গ্রামটি কোথায়, সঠিক বানান তৈরি করে মানচিত্র করলাম।

তারপর কুষ্টিয়া জেলার মানচিত্র তৈরি করলাম। কুষ্টিয়া জেলার ৯৭৯টি গ্রাম, ৬৫টি ইউনিয়ন ,টা পৌরসভা,টা উপজেলা,টা থানা।

একটা ইউনিয়নে কয়টি গ্রাম, গ্রামের বানানটি সঠিক ভাবে করার জন্য আমার এই উদ্যোগ।

“আমার বাড়ির “সরিষাডুলী”লোকে বলে শস্যডুলি,পাশে একটা গ্রাম ‘“বড়গাংদিয়া”  লোকে বলে বাড়াগান্দিয়া, গ্রামের নাম “রওশনপুর”  লোকে বলে “রসুনপুর”। এই যে আমরা শিক্ষিত মানুষ কেন বানান ভুল করব!”

“আমি ৬৪ জেলার মানচিত্র তৈরি করতে আগ্রহী কিন্ত দুর্ভাগ্য এগুলো বিক্রি করার লোক নেই। যদি বন্টন করার লোক না পাই তাহলে আমি কিভাবে করব?”

 

তারপর বাংলাদেশের ৪০৫টি চলমান নদী, কোথায় কোনটির উৎপত্তি, কোথায় শাখা নদী, কোথায় উপনদী এ নিয়ে বাংলাদেশের নদ নদীর মানচিত্র। তারপরে রেলপথে বাংলাদেশ মানচিত্র তৈরি করলাম।

কোন ট্রেন কোন পথে ছাড়ে, কোথায় যায়, কোন স্টেশনের পর কোন স্টেশন, কোনটি জংশন, কোনটা জেনারেল স্টেশন, কোনটা ডাবল লাইন, প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর বিস্তারিত বিবরণ “রেলপথে বাংলাদেশের” মানচিত্রে প্রদর্শিত রয়েছে। 

এরপর তৈরি করলাম “ভারত চিকিৎসা ব্যবস্থার মানচিত্র”। আমরা অনেকেই চিনি না জানি না, ট্রেনে যাব ভাড়া কত! এগুলো নিয়ে মানচিত্র করলাম।

 

YSSE: স্যার আপনি যে ভারতের মানচিত্র করেছেন তা অনেক উপকারে আসবে। এ নিয়ে যদি বিস্তারিত ভাবে বলতেন।

টিপু সুলতান : কোন হাসপাতাল কোথায়, হাসপাতালের ইমেইল, ডাক্তারের নাম্বার, ট্রেনে যাবেন ভাড়া কত! এই তথ্য নিয়ে পুরো মানচিত্র।

 

YSSE : স্যার আপনার লাস্ট বইটির BONUS” ( Analysis of Word) এটা অন্যগুলো থেকে একটু ভিন্ন।

টিপু সুলতান : সবগুলো বই ভিন্ন, আমি নিজস্ব থিওরি ব্যবহার করেছি। আসলে অনেক সময় আমরা সব বানান মনে রাখতে পারি না। আমার নিজেরই বানান মনে থাকে না। এইজন্য এ বই লিখলাম। যাতে মানুষের কল্যাণে আসে সহজভাবে বানান মনে রাখার জন্য।

ছোট্ট একটা উদাহরণ  –

“Calendar”বানানটা ”Der” না “Dar” এ দিয়ে একটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকি। মূলত “Calendar”  বানানটা দুটোই হবে।

Calendar হলো পঞ্জিকা আর Calender হলো ইস্ত্রি করা।

কেউ কেউ হয়তো মনে রাখবে বা কেউ কেউ ভুলে যাবে।

 কিন্ত আমি একটা থিওরি দিলাম: “আমরাও কোথাও যাওয়ার জন্য প্রথমে কত তারিখ যাব তার জন্য ক্যালেন্ডার দেখি তাহলে প্রথম Letter “A”  

এরপরে কাপড় কাচলাম ,রোদে শুকালাম,অনেক পরে ইস্ত্রি করলাম তাহলে অনেক পরে A,B,C,D,‌“E “এটা হলো ‍Calender এর বানান ।”

 

“আমার লজিক একজন টিচার যদি ক্লাসে সুন্দর করে দেখায়, তবে ছাত্ররা ভুলবে না। বাচ্চাদের সাথে রসিকতা করে শিখাতে হবে, তাহলে খুব সহজ ভাবে শিখবে, মজা পাবে।

দেখা যায়, শিক্ষক অনেক কষ্ট করে ক্লাস নেন, ছাত্রদের মনোযোগ পাননা। তার মানে হল, ছাত্ররা যেভাবে চাচ্ছে আমরা সেভাবে তাদেরকে দিতে পারছিনা। আর আপনি যদি গল্প আকারে বলেন,সুন্দর করে ছাত্রদের মনোযোগ ফিরে পাবেন তাহলে অল্প সময়ে বহু কিছু শেখানো সম্ভব।

Enjoyment ছাড়া কোন কিছুই সম্ভব না, শিক্ষার মধ্যে আনন্দ পেলে শিক্ষককে আনন্দ হিসাবে নিবে। আর শিক্ষাকে জটিল ভাবে উপস্থাপন করলে  Acceptance আসবে না।”

এটাই আমার বোনাস বইয়ের মূল উদ্দেশ্য।

যেমন Bonus Common word এই ” Bonus ” এর B বাদ দেন Onus” অর্থ “দায়িত্বভার” এভাবে আমার বইটা রিভিউ করে প্রত্যেকটা বই “‍BONUS” পাবেন।

“German”বানানটা Geনা  Gar অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন, জার্মান দেশটা বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে কয়েকটা দেশ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়, তেমনি E”  Letter টিও  অনেক পরে তাই German হয়ে গেল। এই যে পলিসি গুলো দিলাম আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি একজন টিচার যদি আমার বইটা পড়ে রিডিং পড়ে তাহলে, তাঁর টিচিং Policy  তে Revolution  আসতে বাধ্য।“

“ছাত্রদের মনোরঞ্জন করবেন সহজভাবে শিখাতে পারবেন।”

 

YSSE : আপনি আপনার পেশায় তরুণদের কেন আসতে বলবেন?

টিপু সুলতান –আসলে মানুষের মনের মধ্যে পৌঁছাতে হলে Actual Award পেতে হলে সবচেয়ে সহজ কাজটা লেখার মাধ্যমে‌ করা সম্ভব। মানুষের পাঠন-পঠনের ইতিহাস তা বারবার প্রমাণ করেছে।”

এটা আর্থিক মূল্যে পরিমাপ করা যাবে ‌না। এর প্রাপ্তি সুদূরপ্রসারী। এটার দাম ১০ টাকা ২০ টাকা ৫০০ টাকা তা না। টাকার মালিক হলেই নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায় না। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্যে কল্যণকর কিছু করতে হবে যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের বিচার নেই।

আমি ঠিকাদারি ব্যবসা করি এ ব্যবসায় টাকা রোজগার ছাড়া আর কিছুই করা যায় না ।

মানুষ টাকা রোজগার করে মৃত্যুর পরে একটা টাকাও নিয়ে যেতে পারে না। সে শুধু দেখে যে আমার কাছে এত কিছু আছে কিন্তু আজ কিছুই কাজে লাগছে না।

কিন্তু আমি লেখার মাধ্যমে তা পেয়েছি তা অর্থের তুলনায় অনেক বেশি। আমি মনে করি, আমি যতটুকু জানি তা আমার মধ্যে সিমাবদ্ধ থাকলে হবে নাযদি আমার উদ্দেশ্য ভালো থাকে সেটা যদি আমি লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করি তাহলে এটা হাজার হাজার মানুষের উপকারে আসবে।

এই যে আমি BONUS” বইটা লিখেছি আমাকে Bangladesh Agriculture University” এর প্রফেসর বললেন আপনার বইটি এক কথায় চমৎকার! 

আরেকবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অধ্যাপক আমার প্রথম বই “রেলপথে বাংলাদেশ” কিনেছিলেন। আমাকে ডিপার্টমেন্টে ডেকেছিলেন ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য।

তারপর “বাংলাদেশের শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটির চেয়ারম্যান” আমাকে এক কনফারেন্সে ডেকেছিলেন। ওই কনফারেন্সে  শেরেবাংলা কৃষি বিদ্যালয়এর মাননীয় সাবেক ভিসি স্যার “প্রফেসর ডঃ কামাল আহমেদ”এবং অনেকগুলো অধ্যক্ষের উপস্থিতিতে আমাকে পুরস্কৃত করলেন।

 

YSSE : আপনার এই দীর্ঘ জীবনে কখনো কি ব্যর্থতা এসেছে? যদি এসে থাকে তাহলে আপনি কিভাবে তা মোকাবেলা করেছেন?

 টিপু সুলতান :  যদি ব্যবসায়ী জীবন নিয়ে বলি তাহলে ব্যবসা মানেইতো লাভ এবং লস।

কিন্ত লেখালেখি জীবনে আমি কখনো ব্যর্থতা পাইনি। একটাই ব্যর্থতা- “আমি দেশ ও জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারতাম যদি আমার বই গুলো বিক্রি করার জন্য কোনো প্ল্যাটফর্ম পেতাম।”

আমি অনেক বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত সেগুলো ছাপাতে পারছি‌ না। সেলসম্যান এর অভাবে। বাংলাদেশের মানুষ যদি আমাকে সেলসম্যান দিতে পারত তবে আমি  পৃথিবীতে অনেক কিছু দিতে পারতাম। আপনারা জানেন বাংলাদেশে বেকার মানুষের হার অগণিত। আমার অভিজ্ঞতা সেই বেকার শ্রেণীর মাঝে। আপনার কাজ সমাপ্ত করার জন্য একজনকেও পাবেন না।

আমি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র তৈরি করেছি, গণিতের উপরেও একটি বই তৈরি হচ্ছে, সঠিক শুদ্ধ বানানের উপর একটি বই তৈরি হচ্ছে, এগুলো প্রিন্ট করতে পারছি না, বিক্রয় করতে না পারলে বানাবো কেন?

 

YSSE : নতুন লেখকদের জন্য আপনার যে কোনো পাঁচটি উপদেশ কী থাকবে?

 টিপু সুলতান :  

  • ‌প্রথম কথা হলো বইটা মানসম্মত হতে হবে।
  • ‌আমি কোন উদ্দেশ্যে লিখছি সেটা পুরোপুরি ভাবে বইয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে ।
  • ‌মানুষ মাত্রই ভুল করে। তবে ভুলের পরিমাণ যাতে বইয়ের কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • ‌বাস্তবমুখী হতে হবে। বাস্তবজীবনে সহায়ক এমন বই তৈরি করতে হবে।
  • ‌বইটির একটি নির্দিষ্ট মূল্য ঠিক করতে হবে। আপনি যদি বেশি দামে বই বিক্রি করেন তাহলে অনেকে ক্রয় করতে পারবে‌ন না। আবার যদি অতিকম দামে দেন তাহলে মানুষ এটাকে তুচ্ছ মনে করবে। যা মোটেও ঠিক না।

আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অধ্যাপক বললেন-
”আপনার বইটির দাম ২০০ টাকা করবেন।” ”আমি বললাম-  “স্যার,২০০ টাকা না ১৫০ টাকা।” এই যে আমি ৫০ টাকা কমিয়ে রেখেছি এতে কিছু মানুষের পক্ষে হলেও বইটি ক্রয় করতে সহজ হবে।

“আসলে আমি জীবন যাপন করার চেষ্টা করি খুব সততার সাথে। আমি নয়-ছয় পছন্দ করিনা, অবৈধ রোজগারও পছন্দ করি না”

 

YSSE : আপনি নিজেই বই বিক্রি করছেন আপনার এই সাহস ও অনুপ্রেরণায় কিভাবে এসেছে?

টিপু সুলতান: কেউ যখন আমার বইটি বিক্রি করার দায়িত্ব নিল না আমি বাধ্য হয়ে হকার হলাম।আমি নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম- আমি বইটি বিক্রি করবই।

 

YSSE:  নিজের বই নিজে বিক্রি করতে পরিবার থেকে বা আশেপাশের মানুষ থেকে কখনো কটুকথার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

টিপু সুলতান: এটা তো সব সময়! কেউ পছন্দ করে না কেন আমি বই বিক্রি করি, আমি ঠিকাদার মানুষ, কেন আমি হকার হলাম! আমার গ্রামের মানুষ আত্মীয়স্বজন সবাই আমাকে ছোট করে এই কাজের জন্য। 

“আর কাজ পেল না বই বিক্রি করা শুরু করলো!!” 

আমি মনে করি যাদের শিক্ষার দুর্বলতা আছে তারা সবসময় আমাকে ছোট করেই দেখবে। কিন্তু, যারা বিদ্যার সাথে সম্পৃক্ত তারা সব সময় আমার প্রশংসা করেন।

 

YSSE: বই বিক্রি করতে গিয়ে আপনার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?

টিপু সুলতান: যারা বলে আমার কাছে এখন টাকা নেই তাদেরকে আমি বই দিয়ে দিই। কিন্তু বলি- দয়া করে পরবর্তীতে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিবেন। চেনা নাই জানা নাই তবু আমাকে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এই বিশ্বাসই আমার বড় অর্জন।

আমি যদি বুঝি একজন লোক বই পড়তে জানে, কিন্তু,  তার কাছে ক্রয় করার টাকা নেই ,তাহলে আমি বিনামূল্যে দিই।

 

YSSE : শিখার অনেক কিছুই বাকি আছে আমাদের! আপনার লেখা বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে পছন্দনীয় বই কোনটি?

টিপু সুলতান: আসলে আমিতো বই তেমন প্রিন্ট করতে পারিনি তবে দুইটা বইই মানুষের উপকারে এসেছে। 

যেমন- 

 “রেলপথে বাংলাদেশ” বই এ রেল যোগাযোগের সবকিছুই আছে। ধরেন আপনার বের হতে দেরি হয়ে গেল, এখন আপনি কিভাবে জানবেন ট্রেনটি এখনো আছে নাকি ছেড়ে দিয়েছে? আপনি ট্রেনকে একটা এসএমএস করলেন সাথে সাথে খবর পেয়ে গেলেন। এতে আপনার সময়টাও বেঁচে গেল।

BONUS” বইটাও সেই রকমই।আমাদের অনেকেরই কাছে সিঁদুরের ইংরেজি জানা নেই।আবার আমরা অনেকে ফিটকিরি ব্যবহার করি সেটার ইংরেজি আমরা জানি না। আমি একবার বলব আর ভুলবেন না। কিভাবে? শুনুন-

ইংরেজিতে আছে  Aluminium” । এর প্রথম অংশ Alum” অর্থ “ফিটকিরি”। এর শেষ অংশ Min” মানে “সিঁদুর”

 একজন  শিক্ষক যদি আমার বইটি পড়েন তাহলে তাঁদের ছাত্রদের বোঝানো, পড়ানো অনেক সহজ হবে।

 

YSSE : আমাদের তরুণদের অনেকের মাঝে একটা প্রবণতা দেখা যায় খুব তাড়াতাড়ি বিষণ্ণতা চলে আসে, আমরা ফলটা খুব তাড়াতাড়ি পেতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্যে আপনি কি পরামর্শ দিবেন?

টিপু সুলতান : এটা সবাই চাই।

মনে রাখতে হবে যে জিনিস যত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবেন, তার দীর্ঘস্থায়িত্ব ততটুকুই কম। ভালো কিছু করতে হলে সময় দিতে হবে আমাদের। জানেন তো কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন-

 “যে গাছ লকলক করে বাড়ে, অল্প বাতাসে তার কোমর ভাঙ্গে।”

 

YSSE: আপনার ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস ছিল না, পরে আপনি লেখালেখি শুরু করেন। দেখা যায় যান্ত্রিক পৃথিবীতে সবার সাথে তাল মিলাতে গিয়ে আমরা আমাদের শখটিকে ভুলে যাই বা আমরা আমাদের ইচ্ছা গুলোকে বিকশিত করতে পারি না। এক্ষেত্রে আপনি কি উপদেশ দেবেন?

টিপু সুলতান : আমরা রবীন্দ্রনাথের মতো না। রবীন্দ্রনাথ জন্ম নিয়েছেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। আমাদের বেশিরভাগই খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থানের জন্য কর্মে নিয়োজিত হতে হয়। কিন্তু যে যতটুকু পারি, সময় বের করে আমাদেরকে নিজের জন্য কিছু করা উচিত। 

আমি মনে করি প্রতিভা প্রত্যেকেরই আছে। যিনি কৃষক তারও আছে যে বিজ্ঞানী তারও আছে। যিনি শিক্ষিত তারও আছে, যিনি লেখাপড়া করেননি তারও আছে।

একজন কৃষক যখন ধান চাষ করে তিনি তখন বাস্তবমুখী অনেক অভিজ্ঞতা সেখান থেকে অর্জন করেন।

একজন কৃষক যদি চিন্তাভাবনা করেন যে আমার জমিতে ফসল ফলাতে হলে কতটুকু চাষ করতে হবে, কতটুকু সার দিতে হবে, এটা যদি সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেন, আর সেটা যদি মাইলফলক হয়, তবে তিনি তো বিজ্ঞানীর মতোই কাজ করলেন।

একজন কৃষক যা করেন তা একজন শিক্ষিত লোক তা পারবেন না।আমাদের সকলের মধ্যেই প্রতিভা আছে।

সুতরাং,আমাদের যতটুকু জানা আছে তার মধ্যে সময় বের করে মনোযোগ সহকারে আমাদের কিছু করা উচিত।

 

YSSE: আপনার পাঠকদের সাথে এমন কোনো স্মৃতি আছে যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?

টিপু সুলতান: কয়েকদিন আগের একটা ঘটনা বলছি-

আমি আর আমার ছেলে রিকশায় করে যাচ্ছিলাম। একজন হঠাৎ রিক্সার সামনে দৌঁড়ে এল। সালাম দিল। আমি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিরে বাবা দৌঁড়ে এলি কেন?

স্যার আমি আপনার বইটি নিয়েছি এবং এটি পড়ে আমার অনেক ভালো লেগেছে। তাই আপনাকে সালাম দেওয়ার জন্য এলাম।

আরেকটা ঘটনা হলো, একদিন আমি বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম দীর্ঘক্ষণ। গুলিস্থানের দিকে যাব। একটি বাসেও উঠতে পারলাম না। এক অপরিচিত লোক তখন প্রাইভেট গাড়ি থেকে ডাকলেন। বললো-  “ভাই আপনার কাছে কি বই আছে? আমি বোনাস বইটি কিনব।” তার সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো এবং আমরা একই গন্তব্যে রওনা দিয়েছিলাম। এই কারণে তার গাড়িতে উঠলাম। দেখুন কিভাবে আমার সেই প্রতিক্ষার অবসান বই দিয়েই হলো।

এরকম বহু স্মৃতি রয়েছে যা আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেয়।

 

 

আমরা আমাদের আজকের সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি।এই মানুষটি নিজের কাজ কে ভালোবাসেন, নিজের চিন্তা শক্তি, ক্ষমতা, উদার মানসিকতা, সবকিছু দিয়ে আশেপাশের মানুষের কটুক্তি তুচ্ছ করে আজকে এই পর্যায়ে এসেছেন।  

 

স্যারের লেখালেখির সাফল্যের পেছনের গল্প কষ্টদায়ক সত্যি। এই  বিজয়ের গল্পে, এ.পি.জে আব্দুল কালামের একটি উক্তি  মনে পড়ছে- 

 তুমি যদি তোমার কাজকে স্যালুট করো, তাহলে তোমার আর কাউকে স্যালুট করতে হবেনা কিন্ত যদি তুমি তোমার কাজকে অসম্মান করো, ফাঁকি দাও কিংবা অমর্যাদা করো, তাহলে তোমার সবাইকে স্যালুট করে যেতে হবে।”

টিপু সুলতান স্যার মানবতার ফেরিওয়ালা ও স্বপ্নবাজ লেখকদের জন্য একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। আশা করি সামনে আমাদের তরুণরা এভাবেই সাহসিকতার  সাথে সৎ কাজে সামনে এগিয়ে আসবে।

 

আমাদের আরো নিত্যনতুন ব্লগ পড়তে এখানে  ক্লিক করুন

 

শুভেচ্ছান্তে,

মায়িশা চৌধুরী,

কনটেন্ট রাইটিং ইনটার্ন,

ওয়াইএসএসই।