গ্রন্থ : সূর্য গ্রহণ
লেখক : জহির রায়হান
প্রকাশ কাল : ১৯৫৫
পটভূমি :১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।
বাংলা সাহিত্যে জহির রায়হান এক অনন্য নাম । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার খবর বহিঃবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে তার “স্টপ জেনোসাইড ” যেন একটি মাইলফলক। তেমনি ভাষা আন্দোলনের উপজীব্য নিয়ে রচিত সূর্য গ্রহণ একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
জহির রায়হান, বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান লেখক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জহির রায়হান একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা।
গ্রন্থালোচনা
১৯৫৫ সালে ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্য গ্রহণ। যেখানে উঠে এসেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের করুন কাহিনী। সদা বিপ্লবী ও অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর এক তরুণ ও তার অপেক্ষারত পরিবারের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এই গল্পে। যার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে মাতৃভাষার সম্মান ছিল সবার আগে।
মূল কাহিনী
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন হাসিনা, তসলিম ও আনোয়ার নামে একজন ভদ্রলোক। আনোয়ার সাহেব, যিনি একটা মেসে তসলিমের সাথে রুম ভাগাভাগি করে থাকতেন । কোন রকম চাকরি আর টিউশন পড়িয়ে যার জীবন চলে। তার উপর তার কাঁধে রয়েছে বিশাল দায়বদ্ধতা। এক অজানা সংশয় তাকে ঘিরে ধরে বারংবার।
প্রতিমাসে রোজ একটি করে চিঠি আসে তার ঠিকানায় । নিয়ম করে টাকাও পাঠানো হয় সেই ঠিকানায় । চিঠির প্রাপক হাসিনা বেগম । এ পর্যন্ত অনেক চিঠিই জমেছে তার কাছে কিন্তু একটিও উত্তর দেয়া হয়নি। এদিকে জন্মের পর মেয়েটি এখনো তার বাবা কে দেখতে পায়নি বলে অনেকটা আক্ষেপ করেন হাসিনা । তাইতো হাসিনা অনেকটা অভিমানের সুরে লিখে যায়–
ওগো! এমন করে আর কতোদিন দূরে ঠেলে রাখবে আমায়। আজ পুরো একটি বছর হতে চললো প্রায় বাড়ি আসোনা তুমি। একটি বারের জন্যও তোমায় দেখিনি এই একটি বছর। আগের বছর কতোবার আসতে তুমি মনে আছে?
এতো আকুলতা,অনুনয় বিননয়, অভিমান, শত কোটিবার ক্ষমা প্রার্থনার পরও একটি বারও চিঠির উত্তর না দেয়াতে আনোয়ার সাহেব অদৃশ্য যন্ত্রণায় ভোগেন। হাসিনা তো তার কেউ হয়না। তাহলে? এভাবেই লেখক গল্পের মধ্যে রহস্যের ছড়িয়ে দিয়েছেন। মাসে মাসে সংসার খরচ তো সময়মতো পাঠানো হয়। তা নিশ্চিত করে যা লেখা হয় – টাকা পেয়োছি। মাসে মাসে বাজার খরচের টাকা কটি পাঠিয়েই যদি তুমি তোমার দায়িত্ব শেষ বলে মনে করো তাহলে আর বলার কিছুই নেই।
তসলিম, প্রশস্ত কপালের উপর তেলবিহীন উস্কোখুস্কো চুল। মুখভরা খোঁচা দাঁড়ি। হপ্তার মাত্র একবার সেইভ করতো তসলিম।
একটা ছোটখাটো চাকরির পাশাপাশি নিজেকে কবি হিসেবে দাবি করতো তসলিম। অবসরে লিখতে পছন্দ করতো কবিতা। আর তা অনেকটা জোর করে পড়ে শোনাতেন সবাইকে। যেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে রাজপথ উত্তাল ছিল সেদিন তসলিম ছিল আর সবার মতো রাস্তায়। সারা রাত পোষ্টার প্লেকার্ড লিখে প্রকাশ করেন ক্ষোভ। তারপর কোথা থেকে কি হয়ে গেলো! শেষ বার দেখা গিয়েছিল হাইকোর্টের মোড়ে। এদিকে ঘটনার পরিক্রমার পেছনের পরিবারটি আমৃত্যু জানতে পেরেছিল কি? তারা কি আদোও জানতে পেরেছিল তাদের প্রিয় মানুষটির কি হয়েছিল? অনেকটা রহস্য দিয়ে শুরু হলেও শেষটা ছিল আক্ষেপ ও বেদনায় পূর্ণ। একজন নারীর সম্পূর্ণ জীবন কিভাবে কখানি চিঠির মায়াজালে আবদ্ধ ছিল তার প্রকাশ ঘটাতে লেখক যথেষ্ট দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রভাব
তৎকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কতোটা ব্যপক ছিল তা এই গল্পটি না পড়লে বুঝার উপায় নেই। একমাত্র জহির রায়হানের রচনায় তৎকালীন সমাজ চিন্তা ও মানুষের জীবনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে নিখুঁত ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানের কিছু সৃষ্টি আজও বর্তমান প্রজন্ম কে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তুলে।
পরিশেষে, আমাদের সকলের চেতনায় ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারী বীর পুরুষদের স্মৃতি চির অম্লান হোক। জহির রায়হানের অমর সৃষ্টি পৌঁছে যাক পৃথিবীর সকল প্রান্তে।
আরও ব্লগ পরতে এখানে #ক্লিক করুন।
Writer
Baitul Hikma
Intern, Content writing Department. YSSE.