চড়ুইভাতি ; শব্দটি শুনলেই মনের মধ্যে উঁকি মারে ছেলেবেলার একরাশ সোনালী স্মৃতি। ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে যাই শৈশবের দুরন্তপনায়। যা এক নিমেষে দূর করে দেয় যত ক্লান্তি, গ্লানি, অপ্রাপ্তি। আচ্ছা, চারপাশে কেমন যেনো উৎসব উৎসব আমেজ তাই না? 

কারণ ধরণীতে শীত চলে এসেছে তার আগমনী বার্তা নিয়ে। এখনই সময় চড়ুইভাতি আয়োজনের।  হাড়হিম করা শীতে এপাড়ার ওপাড়ার ছেলেমেয়েরা হৈ- হুল্লোড় করে নেমে পড়ে বনে বাঁধারে। কেউ সবজি কুঁটে,উনুন ধরায়, হাঁড়ি চড়ায়, আবার কেউবা খুঁজে লাকড়ি। সব কিছু ছাপিয়ে আনন্দ টাই যেন মুখ্য। আর এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে চড়ুইভাতির সংস্কৃতি। 

তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক চড়ুইভাতির আদ্যোপান্ত ঃ

‘চড়ুইভাতি’ কি ও কিভাবে এলো? 

‘চড়ুই’ ও ‘ভাত’ শব্দদ্বয়ের সমন্বিত রূপের সাথে ই-প্রত্যয় যোগে গঠিত হয়েছে চড়ুইভাতি। এর গঠনগত অর্থ চড়ুই পাখির ভাত অন্যদিকে এর অন্তর্নিহিত অর্থ যা দাঁড়ায় ” খুব অল্প পরিমাণ ভাত”।

এছাড়া চড়ুইভাতি, যাকে আক্ষরিক অর্থে বনভোজন বলা হয়। তবে একে বনভোজনের ছোট সংস্করণ বল্লেও ভুল হবে না । অঞ্চলভেদে নামের মধ্যেও তারতম্য রয়েছে বেশ। কোন কোন অঞ্চলে টোপাভাতি, টোপাপাতি (মাটির ছোট টোপা পাতিলে রান্না ) চড়িভাতি, টোলাপাতি নামেও পরিচিত। 

ইতোমধ্যে  হয়তো ভাবছেন চড়ুই কথাটি এলো কিভাবে? 

বন জঙ্গলে  একঝাঁক চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করে খাবার খুঁটে খুঁটে খাই তখন দেখতে বেশ আনন্দ লাগে। এদের সাথে মিল রেখেই বোধহয়  এর নামকরণ করা হয়েছে। যেখানে একঝাঁক ছেলেমেয়েরা চড়ুইপাখির মতো আনন্দ উল্লাস করে বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা চাল ডাল সংক্ষিপ্ত পরিসরে  রান্না করে খায়।  

আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঃ

প্রাচীন কাল থেকে এটি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে মিশে আছে। তারই অস্তিত্ব পাওয়া যায় অসংখ্য  কাব্য, সাহিত্য, সংস্কৃতির পাতায় পাতায়। 

জানা যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  ‘চড়িভাতি‘ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯০২ সালে (দমদমের বাগানে চড়িভাতি করিয়া আসা যাক)। 

কবি গোলাম মোস্তফা রচিত বনভোজন  নিয়ে লিখা কবিতার কটা লাইন যেন এর  সফল প্রয়োগ –

কেউবা বসে হলদি বাটে, কেউবা রাঁধে ভাত 

কেউবা বলে ধুত্তোরি ছাই পুড়েই গেলো হাত। 

বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা

তবুও সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগে কাঁদা। 

কখন ও কিভাবে আয়োজন করা হয় ঃ

পাশ্চাত্যের দেশ গুলোতে সাধারণ গ্রীষ্মকালে বনভোজন বেশ ঘটা করে আয়োজন করতে দেখা যায়। অপরদিকে, এশিয়ার দেশগুলোতে গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকাল চড়ুইভাতি বা বনভোজনের উপযুক্ত সময় হিসেবে ধরা হয়। চারদিকে সাজ সাজ রব, হাড় কাঁপানো শীত,একটু উষ্ণতা, মিষ্টি রোদ, নতুন শাক-সবজি, চাল- ডাল যেন এক  নতুনমাত্রা যোগ করে। 

এখন আসি কিভাবে আয়োজন করা হয় সেই প্রসঙ্গে

চড়ুইভাতি আয়োজনের নিয়ম কানুন খুবই সহজ। হঠাৎ উদ্যোগে হাতের কাছে যা যা আছে তা দিয়েই চলে রান্নার জোগাড়যন্ত। এদিকে পর্দার আড়াল থেকে মা-চাচী’রা শিখিয়ে পড়িয়ে দেন কিভাবে কি করতে হবে। বাড়ির পাশে, নদীর তীরে বা আশে পাশের বন জঙ্গল পরিস্কার করে নিলেই ব্যস হয়ে গেলো। এবার মাটি খুঁড়ে উনুন তৈরি, এ ঘর ওঘর থেকে চাল- ডাল তেল, নুন, শাক-সবজি, মাছ, মাংস দিয়ে গ্রাম বাংলার কিশোর -কিশোরীদের আনাড়ি হাতের বাহারি রান্না যেন সত্যিই অমৃত। 

বনভোজন ও চড়ুইভাতির মধ্যে পার্থক্য ঃ

বনভোজন বা পিকনিক যেখানে পুরোটাই  আধুনিকতায় মোড়ানো সেখানে চড়ুইভাতি আজও সাদামাটা। আজকাল বনভোজনে ছোট- বড় সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। অন্যদিকে চড়ুইভাতি নিতান্তই ছেলেমেয়েদের শখ ও আনন্দের প্রতিফলন মাত্র।  চড়ুইভাতি বনভোজনের মতো বৃহৎ পরিসরের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরে করা হয়।

 চড়ুইভাতি কি হারিয়ে যাচ্ছে?

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অনেক উপজীব্যই আজকালে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।  খুঁজ নিলে জানা যাবে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে চড়ুইভাতি অজানা এক শব্দ। তবে আশার কথা, এখনো অনেক গ্রামাঞ্চলের মানুষ এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পরম যত্নে। 

 

পরিশেষে,  যে যেভাবে যে নামেই ডাকুক না কেন এক সময় এগুলোই  ছিল অনাবিল আনন্দে ভরপুর। কি নেই এতে? মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে সহায়ক পরিবেশ , শিক্ষামূলক আচার আচরণ ও চিত্তবিনোদনের অফুরন্ত উৎস। সার্বিক বিবেচনায় চড়ুইভাতি এক ও অনন্য। 

 

Writer:–

Baitul Hikma 

Intern, Content Writing Department. 

YSSE