পৃথিবীর মানচিত্রে  উত্তর-পূর্ব গোলার্ধে অবস্থিত সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং সুনিপুণ শিক্ষা ব্যবস্থার একটি দেশ, যা রকমারি চেরি ফুল, মাউন্ট ফুজির মতো দর্শনীয় স্থান;বুলেট ট্রেন, কারাওকের মতো নান্দনিক সব উদ্ভাবন এবং ভিন্নধর্মী সুশি ও রামেনের দেশ হিসেবেও সর্বাধিক পরিচিত।  হ্যাঁ , কথা বলছি সূর্যোদয়ের দেশ তথা জাপানের। জাপান এমন একটি দেশ যেখানে প্রতিনিয়ত চর্চা হয় নিপুণতার এবং সৌহার্দ্যের।

 শিক্ষা- দীক্ষায় যে সকল রাষ্ট্র নিজেদের এভারেস্টের চূড়ার পদমর্যাদা দিতে চান,  সে সকল রাষ্ট্রের জন্য জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা এক প্রকার আদর্শ।  

কেন জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থাই সেরা? 

জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলতে গেলে শুরুতেই বলতে হয়,  জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা একে  অপরের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। তাই তো কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনাকালীন তাদের সর্বপ্রথম শেখানো হয় কিভাবে পরিচিত মানুষকে দেখে অভিবাদন জানাবে। (কননিচিওয়া -হ্যালো),  কারো দ্বারা বিন্দুমাত্র উপকৃত হলে জানাবে কৃতজ্ঞতা ( আরিগাতোউ- ধন্যবাদ ),  আর ভুল করা মাত্রই কোনো দ্বিতীয় চিন্তা না করে দুঃখ প্রকাশ করবে ( গোমেননাসাই – দুঃখিত) ।    মূলত তাদের জীবনের এই অনুকরণীয় সুশৃঙ্খলতার মূল ভিত্তিই হলো তাদের সুশিক্ষা।

জাপানের বিদ্যালয় গুলোতে যে প্রক্রিয়াতে পাঠদান করানো হয় তাকে শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়

 “জীবনব্যাপী শিক্ষা “। আর তাই সেখানকার মানুষেরা কেবল ভাষা,  সাহিত্য,  গণিত,  বিজ্ঞান এসব বিষয়েই নয় জীবনের সকল পর্যায়ে থাকে অন্যান্য দেশের মানুষের থেকে এগিয়ে। উন্নত সব প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় জাপান পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা ধারণ করে। আর তাই প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার নিমিত্তে জাপানে পাড়ি জমায়। তবে বলা বাহুল্য জাপানী শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদানের ক্ষেত্রে জাপানি ভাষা ব্যবহার করা হয়ে থাকে বলে, শিক্ষার্থীকে অবশ্যই তা আয়ত্তে আনতে হয়। 

স্বল্পমেয়াদী শিক্ষা  

যেহেতু একজন শিশু খুব ছোট বয়স থেকে শৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে বেড়ে ওঠে তাই প্রায় সকল  সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক ঝামেলা মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জাপানে বিদ্যমান।  কারণ জাপান সমাজব্যবস্থা সর্বদা স্বনির্ভরতার শিক্ষা দেয়। নিজের কাজ নিজে সম্পাদন করার মাঝে যে তৃপ্তি, তার স্বাদ জাপানের শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে ৩-৪ বছর বয়সে নিজের জুতোর ফিতে বাঁধা অথবা নিজের খাবার নিজে গ্রহণ করার মাধ্যমে পেয়ে থাকে। 

উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ৪-৬ বছরের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী তার পড়াশোনা সম্পাদন করতে পারবেন। খুব কম সময়ে কোনো রূপ ঝামেলা ছাড়া শিক্ষা সম্পাদন করা যায় বলে,   জ্ঞান পিপাসু তরুণ প্রজন্মের অন্যতম পছন্দের দেশ জাপান। বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৬ টি অবস্থান করছে জাপানে। 

ইউনিভার্সিটি অব টোকিও, ওসাকা ইউনিভার্সিটি,  কিয়ুশু ইউনিভার্সিটি,  টোকিও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ-র মতো শীর্ষ স্থানীয় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান স্টাডিজ,  ভাষা শিক্ষা,  শিক্ষাবিজ্ঞান,  গণিত,  রসায়ন,  পদার্থবিজ্ঞান, মেডিসিন,  বায়োসায়েন্স ও বায়োটেকনোলজি, কম্পিউটার সায়েন্স,  প্রাণবিজ্ঞানসহ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে যে কেউ চাইলেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। 

 

বৃত্তির জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?

জাপানের পড়াশোনার পরিবেশ প্রতিযোগিতামূলক ও সৃজনশীল। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে দুই সেমিস্টারে বিভিন্ন বৃত্তি ও ফেলোশিপ নিয়ে ভর্তি হওয়া যায়। বৃত্তি পেতে হলে ভালো স্কোর থাকতে হবে, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হতে হবে। মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে পড়ার জন্য পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। বৃত্তির জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সনদপত্রের পাশাপাশি ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’, গবেষণা করতে কেন আগ্রহী—এসব নিয়ে অনুচ্ছেদ লিখতে হয়। এ ছাড়া আগের গবেষণার অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সনদও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।

জাপানের পড়াশোনার জন্য টিউশন ফি একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ হাজার ডলার থেকে ফি শুরু হয়। বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ন্যূনতম ৮ হাজার ডলার ফি নেওয়া হয়। জাপানে বৃত্তি ছাড়া পড়াশোনা করার সুযোগ আছে।

রকমারি সুযোগ-সুবিধা 

বর্তমানে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে জাপান একটি।  তাই বিশ্বের প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তারা নিজেদের করে তৈরি করেছে।  জাপানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থীকে ঝামেলা বা হয়রানির স্বীকার হতে হয় না। MEXT,  ADB, World Bank ইত্যাদি স্কলারশিপ এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপানে যেতে পারেন।  MEXT হলো ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু হওয়া জাপানের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাবৃত্তি। যা তাদের স্থানীয় ভাষায় ” মনবু-কাগাকু-শো ” নামে পরিচিত।

স্কলারশিপ ছাড়াও আন্ডার গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স পর্যায়ে খুব সহজে পড়াশোনার জন্য আবেদন করা যায়। এছাড়াও পড়াশোনার পাশাপাশি রয়েছে পার্ট টাইম কাজের সুযোগ। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তার সময়কে যেমন কাজে লাগাতে পারে তেমনি নিজের পড়াশোনার যাবতীয় খরচও চালনা করতে পারে। ফলস্বরূপ জাপান ব্যতিত অন্যান্য দেশগুলো থেকে আসা শিক্ষার্থীরাও স্বনির্ভর এবং কর্মঠ হয়ে উঠে। 

জাপানে পড়ালেখা করে সে দেশে চাকরির সুযোগ 

জাপানে উচ্চশিক্ষা শেষে  বাংলাদেশের শিক্ষার্থী বা গবেষকদের জাপানে চাকরির নানা সুযোগ আছে। জাপানি ভাষা জানলে সুযোগ বেশি। বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করতে পারেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেন অনেকে। জাপানি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগারে বাংলাদেশিরা যোগ দিচ্ছেন। আবার অনেক শিক্ষার্থী সনি, টয়োটা, হিটাচিসহ নামী প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করেন। জাপান থেকে সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।

প্রাকৃতিক সম্পদে পিছিয়ে থেকেও জাপান আজ অনেক উন্নত একটি দেশ। তার কারন হচ্ছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।শিক্ষার অন্যতম  উদ্দেশ্য ( মানুষের আচরণগত পরিবর্তন ঘটানো)  বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা তাদের জনসমষ্টিকে মানবসম্পদে পরিণত করতে সফল হয়েছে। 

এশিয়া মহাদেশে খুব কম সময়ের মধ্যে উন্নয়নের শিখরের সন্ধান লাভ করা দেশ হিসেবে জাপান এ-ই মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এককথায় অনুকরণীয়।

আরও ব্লগ পড়তে এখানে #ক্লিক করুন। 

Writer 

Intern 

Lutfur Nahar

Content writing department 

YSSE